
ভিপি
মো. মাহমুদুল হাসান
জাতীয় পার্টির (জাপা) কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় গণঅধিকার পরিষদ। শুক্রবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে জাপার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে মিছিলে হামলা হয়। এ ঘটনা নিয়ে
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন জানান, জাপা নেতারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। তবে জাপার মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী জানান, জাপার নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট ছোড়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা।
বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুই দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকার কাকরাইল এলাকায় এর জেরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন। গুরুতর আহত নুরুল হক নুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে নেওয়া হয়েছে আইসিইউতে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার কাকরাইলে এ ঘটনা ঘটে। দুটি রাজনৈতিক দলেরই কার্যালয় রয়েছে ওই এলাকায়। এদিকে আইএসপিআর জানিয়েছে, জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়।
এ পর্যন্ত যা ঘটল
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যার দিকে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল শুরু করে গণঅধিকার পরিষদ। মিছিলটি দলটির কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়। বিজয়নগর মোড় থেকে মিছিলটি কাকরাইল-নয়াপল্টন মোড়ের দিকে যেতে থাকে। জাপা কার্যালয়ের সামনে আসলে মিছিলকারীদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কর্মীরা সংঘর্ষ হয়। এতে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ আহত হন। পরে এ নিয়ে মশাল মিছিল শুরু করে গণঅধিকার পরিষদ। শতাধিক নেতাকর্মী জাপা কার্যালয়ে আগুন দিতে যান। ইট-পাটকেল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় এক পুলিশ সদস্যের মাথায় ইট লেগে আহত হন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই গাড়ি সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। তারা জাপা কার্যালয়ে নিরাপত্তা দিয়ে ঘিরে রাখেন। গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা বার বার জাপা কার্যালয়ে ঢুকতে চান।
এদিকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে গণঅধিকার পরিষদ। সোয়া ৯টার দিকে নেতাকর্মীরা সম্মেলনস্থলে চলে যেতে শুরু করেন। কয়েকজন যৌথবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা কথা বলতেছিলেন। তর্কাতর্কি হয়। হঠাৎ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের ধাওয়া দেন। এক পর্যায়ে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ের সামনে থাকা নুরুল হক নুরসহ অন্যদের ওপর হামলা করেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানান, সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। এ সময় আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।
সেখান থেকে ফিরে এসে আবার একটি মশাল মিছিল বের করে গণঅধিকার পরিষদ। সেই মিছিলেও হামলা হয়, বলে অভিযোগ করেন রাশেদ খাঁন। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর অভিযোগ, গ অধিকার পরিষদের মিছিল থেকে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয়। এতে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। তখন, আমাদের কর্মীরা তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আসে। তারা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তবে, এরপর গণঅধিকার পরিষদ মশাল মিছিল নিয়ে পার্টি অফিসে আগুন দিতে আসে বলে অভিযোগ করেন জাপা মহাসচিব। যদিও গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁনের দাবি, তারা জাপা কার্যালয়ের দিকে যাননি। তারা কেবল রাস্তায় মিছিল করেছেন।
মশাল মিছিল বের হওয়ার পর আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাস্থলে।
পুনরায় তাদের মশাল মিছিলে ওপর হামলার অভিযোগ করেন রাশেদ খাঁন। যদিও, জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার বলছেন, তাদের নেতাকর্মীরা মশাল নিয়ে মিছিলকারীদের প্রতিরোধ করেছেন মাত্র। এরপর সেনাবাহিনী এসে এই মব ঠেকিয়ে দেয়।
ঘটনাস্থলে থাকা একজন সাংবাদিক ঝর্ণা রায় বিবিসি বাংলাকে জানান, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। পাল্টাপাল্টি ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় সংবাদকর্মীসহ অনেকে দুই পক্ষের মাঝে আটকা পড়েন। আহতও হন কেউ কেউ।
জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ দুই পক্ষই দাবি করেছে- তাদের ওপর আগে আক্রমণ করেছে অপরপক্ষ। এরপর নিজেদের কার্যালয়ের সামনে একটি সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন গণঅধিকার পরিষদের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীদের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারছেন সেনা সদস্যরা। তাকে বুট দিয়ে লাথি মারতেও দেখা যায়।
রাশেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে জানান, তাদের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তিনি নিজেও ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকেই বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা বলেন। তার অভিযোগ, এদিন জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন।
আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তবে, সেখানে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় গণঅধিকার পরিষদের কর্মীদের।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও হাসপাতালে যান। বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার নিন্দা জানান তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতিসহ অন্যদের ওপর হামলায় ‘তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ’ জানিয়েছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্ধৃত করে এক বিবৃতি বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকে ব্যাহত করে এমন কোন কর্মকাণ্ডকে বিএনপি সমর্থন করে না এবং সুস্থধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলাকেও আমরা নিন্দা জানাই।’
এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এছাড়া উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
নুরুল হক নূরসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শনিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণঅধিকার পরিষদ।
আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
কাকরাইলের ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। যেখানে ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রথমে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেড়ে গেলে তারা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা কামনা করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে কয়েকজন সদস্য আহত হন।
আইএসপিআর বলছে, ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উভয়পক্ষকে শান্ত থাকতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে স্থান ত্যাগ করার জন্য ও দেশের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার অনুরোধ জানায়।
সেনাবাহিনী বলেছে, তবে বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও কতিপয় নেতাকর্মীরা তা উপেক্ষা করে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে। তারা সংগঠিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং আনুমানিক রাত ৯টার দিকে মশাল মিছিলের মাধ্যমে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি করে। এ সময় তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়ারও চেষ্টা চালায়।
এছাড়াও বিজয়নগর, নয়াপল্টন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাধানের সকল চেষ্টা তারা অগ্রাহ্য করে। ফলস্বরূপ, জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয় কণে উল্লেখ করা হয় আইএসপিআরের বিবৃতিতে।
উদ্ভূত ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে আইএসপিআর।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করছে এবং জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আনয়নে সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে। জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সর্বদা বদ্ধপরিকর।
এদিকে রাতে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবর রহমান মঞ্জু জানান, রাজধানীর কাকরাইলে হামলায় আহত গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে আইসিউতে নেওয়া হয়েছে, বাঁচবে কিনা জানি না।
তিনি বলেন, নূরের কিছু হলে তার দায় সেনাপ্রধান ও প্রফেসর ইউনূসকে নিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনাপ্রধান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টাকে বক্তব্য পরিষ্কার করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যারা হামলা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে, নতুবা যমুনা ঘেরাও করা হবে। পুলিশ সেনাবাহিনীর যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে।
মজিবর রহমান মঞ্জু বলেন, নূরকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে, একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।