
সমাচার ডেস্ক
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে পছন্দ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখন সে ধারা বদলাতে শুরু করেছে। আমেরিকার জায়গায় কানাডাকে বেছে নিচ্ছেন ভারতীয় শিক্ষার্থীরা। শিখ হত্যাকাণ্ডসহ কয়েকটি কারণে ভারত–কানাডা সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনের পর হঠাৎ কেন এমনটা হচ্ছে, তা তুলে ধরেছেন ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের সাংবাদিক শ্রুতি বানসাল। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ কানাডার বিভিন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী ভর্তি ছিলেন—যা একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর তুলনায় অনেক বেশি। শুধু তা–ই নয়, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের যাওয়া ৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা আগ্রহ কমে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে।
২০২৫ সালে অ্যাপ্লাইবোর্ডের (ApplyBoard) এক জরিপে দেখা গেছে, বিদেশে পড়াশোনায় ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশ কানাডাকে তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন সাশ্রয়ী খরচ, নিরাপত্তা এবং শিক্ষার্থীবান্ধব অভিবাসন নীতি।
শিক্ষার্থী গমনে উত্থান-পতন
গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা ‘রোলার কোস্টার’-এর মতো অস্থির ছিল বলে উল্লেখ করেন কানাডার হুরন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ও উপাচার্য ব্যারি ক্রেইগ। তিনি বলেন, ‘কোভিডের সময় শিক্ষার্থী আসা প্রায় সম্পূর্ণ থামিয়ে দিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে গতি ফিরে এলেও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনে আবারও কানাডার পরিস্থিতি (শিক্ষার্থী পড়তে আসা) খারাপ হয়ে যায়। এখন আমরা নতুন করে আগ্রহ আগের চেয়ে বেশি দেখছি, যা আমার মতে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত।’
হুরন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধারা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও প্রতিফলিত হয়েছে। শিখ হত্যা নিয়ে ২০২৪ সালের কূটনৈতিক টানাপোড়েনের পর কানাডায় ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করে। তবে এখন গতি ফিরতে শুরু করেছে।
উপাচার্য ব্যারি ক্রেইগ বলেন, ‘গত দুই বছরের তুলনায় আমরা এই শরতের জন্য প্রায় তিন গুণ বেশি আবেদন পাচ্ছি। ভারতীয় শিক্ষার্থীরা কানাডার পড়াশোনা নিয়ে খোঁজও নিচ্ছে বেশি। আসছে সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের মূল শিক্ষা মৌসুম শুরু হবে। আমরা কানাডায় পড়তে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেশি দেখছি।’
খরচের তারতম্য
অনেক শিক্ষার্থীর জন্য মূল পার্থক্য তৈরি করছে খরচের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক খরচ ও খেলাধুলার জন্য ব্যয় বেড়ে যায়। অথচ কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি শিক্ষা ও একাডেমিক মান উন্নয়নে খরচ ব্যয় করে।
উপাচার্য ব্যারি বলেন, ‘আমার এক মেয়ে স্নাতক করেছে কানাডায়, আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে। কানাডায় টিউশন ফি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ কম ছিল। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে হুরনের খরচ কোনো সমপর্যায়ের আমেরিকান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্ধেক। আমরা পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিই না, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অর্থ অপচয় করি না। এভাবেই আমরা খরচ কম রাখি। অথচ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মান বজায় রাখি।’
স্নাতকোত্তর পরবর্তী কাজের সুযোগ
আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শুধু শিক্ষাক্ষেত্র নয়, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও সিদ্ধান্ত নিতে বড় ভূমিকা রাখে। ব্যারির মতে, ‘কানাডার নীতিগুলো এখানে বাড়তি সুবিধা দেয়। কানাডা আকর্ষণীয়, কারণ এখানে তিন বছরের পোস্টগ্র্যাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট (Post-Graduation Work Permit–PGWP) পাওয়া যায়। আমাদের ১০০ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার সময়ই বেতনসহ ইন্টার্নশিপ করে। এর ফলে স্নাতকের ছয় মাসের মধ্যে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা অচেনা দেশে একা হয়ে পড়ে না; বরং শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের সঙ্গে সংযোগ নিয়েই কর্মজগতে প্রবেশ করে।’
নিরাপদ ও অতিথিপ্রবণ পরিবেশ
যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কানাডাকে নিরাপদ ও কম বিভাজিত দেশ হিসেবে দেখা হয়, যা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলে। উপাচার্য ব্যারি বলেন, ‘কানাডায় বেড়ে ওঠার সময় আমি মনে করতাম এটি বিরক্তিকর; পরিষ্কার বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, যুদ্ধ নেই, সহিংসতা খুবই কম। এখন আমি মনে করি, ধন্যবাদ, বিরক্তিকর হওয়াই ভালো। অভিভাবকেরা জানতে চান যে তার সন্তান নিরাপদ থাকবে কি না? আর অনেক দেশের তুলনায় কানাডায় অপরাধের হার খুব কম এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বন্দুক–সন্ত্রাস নেই।’
প্রতিভা আকর্ষণ ও অংশীদারত্ব
কানাডার সুবিধা শুধু শিক্ষার্থীর জন্য নয়, গবেষকদের জন্যও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। সম্প্রতি টরন্টো ইউনিভার্সিটি আইভি লিগ (Ivy League) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজন শীর্ষ গবেষককে কাজে সুযোগ করে দিয়েছে, যারা স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন।
এ ছাড়া হুরন ভারতেও অংশীদারত্ব গড়ছে ইন্ডিয়া অ্যাডভাইজরি কমিটির মাধ্যমে, যেখানে ব্যবসা, কূটনীতি, নীতি ও শিক্ষাক্ষেত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্ত রয়েছেন।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কানাডা আজ ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বেশি সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও ভবিষ্যৎমুখী গন্তব্য। শিক্ষা থেকে কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা থেকে অভিবাসন—সব দিক থেকেই কানাডা হয়ে উঠছে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের নতুন ‘স্বপ্নের দেশ’।