
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। ছবি: ডেইলি স্টারের সৌজন্যে
সমাচার ডেস্ক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
তিনি বলেছেন, রোজার আগে ভোট। এর ৬০ দিন আগে তপশিল ঘোষণা করা হবে। আগামী ৩০ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছে। তালিকা শেষ হলে প্রস্তুতি প্রায় শেষ হবে। প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভোটের জন্য ২৪টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো চিঠিতে আগামী রমজানের আগে ভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী ভোট গ্রহণের তারিখের ৬০ দিন আগে তপশিল ঘোষণা করতে চায় কমিশন। এছাড়া নির্বাচন আয়োজনে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কমিশন প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘কেনো থাকবে না, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমাদের কাজ হলো নির্বাচন-সংক্রান্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’
নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বডি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ব্যাপার বলেও জানান আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটা নির্বাচন কমিশনের চাহিদার বিষয় নয়। তবে প্রয়োজন হলেও কোথায় কতটুকু; হতে হবে আলোচনা সাপেক্ষে।
মানুষ যাতে সুষ্ঠু পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা কমিশন করবে বলেও জানান তিনি। এছাড়া এআই, অসত্য তথ্য, ভুয়া তথ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কমিশন কাজ করছে বলেও জানান ইসি সচিব।
ভোটার তালিকা ও সংসদীয় আসনের সীমানা প্রসঙ্গ
ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী ৩১ আগস্ট সম্পূরক তালিকাসহ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করেছে ইসি। ২ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত যোগ্য ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তি বা অযোগ্য ব্যক্তির নাম বাতিল এবং যেকোনো ত্রুটি পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদনের সময় দেওয়া হয়েছে।
এরপর ৩১ অক্টোবরের সম্পূরক তালিকা শেষে ৩০ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করেছে কমিশন। এছাড়া ১৫ সেপ্টেম্বর সংসদীয় ৩০০ আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আর ৩০ সেপ্টেম্বর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি জিআইএস ম্যাপ প্রকাশ করবে কমিশন।
নির্বাচনে যেসব নতুন রাজনৈতিক দল অংশ নিতে চায়, প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য তাদেরকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে কমিশন। ৩০ সেপ্টেম্বর দলগুলোর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
নির্বাচনে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন এবং সাংবাদিকদের নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে ১৫ সেপ্টেম্বর।
ইসি দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে দেড় মাস ধরে
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করবে কমিশন। যা এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু হবে। শেষ হতে সময় লাগবে দেড় মাস।
নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক মালামাল (মনোনয়নপত্র, প্রতীকের পোস্টার, পরিচালনা ম্যানুয়েল) বিতরণের সম্ভাব্য সময় ১ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেছে কমিশন। এছাড়া ভোটগ্রহণের তারিখের অন্তত ২৫ দিন পূর্বে সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে ভোট কেন্দ্রসমূহের চূড়ান্ত তালিকা।
ইসি সচিব বলেন, ব্যালট বক্সের ব্যবহার উপযোগিতা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন আয়োজনে যতগুলো ব্যালট বক্স প্রয়োজন তা কমিশনের কাছে মজুদ রয়েছে। তিনি জানান, নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করবে কমিশন।
ইসি সচিব জানান, নির্বাচনের বাজেটের বিষয়টি এখনো সম্পন্ন করেনি কমিশন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাজেটের একটা বড় অংশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় এটি করতে কিছুটা সময় লাগবে।
ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়েও কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান তিনি। বলেন, বিদ্যমান নীতিমালায় প্রতি কেন্দ্রে গড়ে তিন হাজার এবং প্রতি বুথে গড়ে ৫০০ পুরুষ এবং ৪০০ মহিলা ভোটার ভোট দিতে পারবেন। তবে পুনর্মূল্যায়ন করে প্রতি বুথে নারী পুরুষ ভোটারের সংখ্যা কিছুটা বাড়ানো হবে। এই তালিকাটি ভোট গ্রহণের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ দিন আগে প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
ইসি সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন উপলক্ষে ২৪টি বিষয় ২০৭ ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলোরই সুনির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ থাকবে রোডম্যাপে। তবে ভোটগ্রহণ বা তপশিলের চূড়ান্ত কোনো তারিখ এখনও নির্ধারণ করেনি ইসি।
ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে বসাসহ ২৪ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে রোডম্যাপে। এর উল্লেখযোগ্য অন্য বিষয়গুলো হচ্ছে- ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনী আইনবিধি সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ চূড়ান্তকরণ, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালার অনুমতি প্রদান, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট আইন-বিধিমালার সংশোধনী একীভূতকরণ এবং ম্যানুয়েল নির্দেশিকা প্রণয়ন, পোস্টার ও পরিচয়পত্র মুদ্রণ, নির্বাচনী দ্রব্যাদি সংগ্রহ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও নির্বাচনী উপকরণ ব্যবহার উপযোগীকরণ, নির্বাচনী বাজেট প্রস্তুত ও বাজেট বরাদ্দ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচনের জন্য জনবল ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কার্যক্রম, আন্তঃমন্ত্রণালয় যোগাযোগ, আইসিটি সহায়তা, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচার, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম, টেলিযোগাযোগব্যবস্থা সুসংহতকরণ, ফলাফল প্রদর্শন, প্রচার ও প্রকাশবিষয়ক ব্যবস্থা গ্রহণ (ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার), ডিজিটাল মনিটর স্থাপন ও যন্ত্রপাতি সংযোজন, বেসরকারি প্রাথমিক ফলাফল প্রচার, পোস্টাল ভোটিং ও বিবিধ।
অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ
নির্বাচনকেন্দ্রিক আট শ্রেণির অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকসহ অংশীজনের সঙ্গে এ সংলাপ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। শেষ হতে সময় লাগবে দেড় মাস। চলবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।
রোডম্যাপে আরও যা থাকছে- নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিবন্ধন ২২ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত করে ১৫ নভেম্বর নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হবে। বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমতি প্রদানে যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করা হবে ১৫ নভেম্বর মধ্যে।
এদিকে ১৫ নভেম্বর মধ্যে নির্বাচনী তথ্য প্রচারের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি মন্ত্রণালয়, টিএন্ডটি, বিটিআরসিসহ বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সঙ্গে সভা করবে ইসি। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও ব্রিফিংয়ে যোগদানের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে। নির্বাচনী ম্যানুয়েল, নির্দেশিকা, পোস্টার ইত্যাদি মুদ্রণ শেষ করা হবে ১৫ সেপ্টেম্বর মধ্যে। নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ২৯ আগস্ট থেকে ভোটগ্রহণের ৪ থেকে ৫ দিন আগে যাবতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করবে ইসি। নির্বাচনের সকল প্রকার মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম শেষ করা হবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। ব্যবহার উপযোগী স্বচ্ছ ব্যালট চূড়ান্ত করা হবে ৩০ নভেম্বর মধ্যে। ১৫ নভেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাজেটে চূড়ান্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনূকূলে অর্থ বরাদ্দে জন্য বৈঠক ১৬ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর মধ্যে।
নির্বাচনের জন্য জনবল ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে চায় ইসি। এছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বরে মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম সভা হবে ২৫ সেপ্টেম্বর।
৩১ অক্টোবরের আইসিটি সংক্রান্ত সকল কাজ শেষ করতে চায় কমিশন। ইসি সচেতনতামূলক প্রচার কাজ শেষ করতে চায় ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। টেলিযোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখা, ফলাফল কীভাব প্রকাশ ও প্রচার করা হবে, বেসরকারি ফলাফল প্রচার সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্ধারণ এবং ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
প্রসঙ্গত, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রোজার আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংক্রান্ত চিঠিও দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ভোটের তারিখের প্রায় দুই মাস আগে তপশিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশন সভায় আলোচনা শেষে জানানো হয়, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল দেবে ইসি।